কমরেড শ্রীকান্ত দাশ তাঁর গানের মাধ্যমে মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। সংগ্রামী সুর ও কথা ছিলো তাঁর অস্ত্র।
সুনামগঞ্জ-শাল্লা উপজেলার মাটি যেমন লড়াকু, তেমনি এই মাটির সন্তান কমরেড শ্রীকান্ত দাশ ছিলেন সংগ্রাম-আদর্শ ও মানুষের প্রতি অটুট দায়িত্ববোধের প্রতীক। তিনি শুধু একজন সাংস্কৃতিক কর্মী ছিলেন না, একজন চিন্তাশীল বামপন্থী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, গণসংগীত রচয়িতা, সুরকার, শিল্পী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তাঁর সমগ্র জীবনটাই ছিল শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্নে নিবেদিত। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শিক অবস্থানে শ্রীকান্ত দাশের রাজনীতির শুরু সমাজতান্ত্রিক চেতনার পথ ধরে। খুব অল্প বয়সেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সমাজের মূল শক্তি শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, দিনমজুর, জেলে ও ভাটি এলাকার হাওরের সাধারণ জনগণ। তাদের জীবন দর্শনই তাঁকে রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় করে তোলে। বাম রাজনীতির প্রতি অবিচল প্রতিশ্রুতিতে তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ এক কমিউনিস্ট কর্মী। তিনি বলেছিলেন- রাজনীতি কখনো ক্ষমতা অর্জনের জন্য নয়, বরং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁর বক্তব্য, গানে ছিল এই মর্মকথা। সামন্তবাদের বিরোধিতা, দরিদ্র মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়, অর্থনৈতিক সমতা, সাংস্কৃতিক মুক্তি, শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা ছিল তাঁর স্বপ্ন। সংগঠক হিসেবে তিনি রেখেছিলেন শক্তিশালী ভূমিকা। শাল্লা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অগ্রগতিতে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বহু তরুণ সমাজসেবা, নাটক, সংগীত এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। গণসংগীত ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে শ্রীকান্ত দাস এক যুগলবন্দিতে ধরে রেখেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর রচিত গান। তিনি গণসংগীতকে দেখতেন রাজনৈতিক শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হিসেবে। তাঁর ভাষা ছিলো সহজ কিন্তু প্রখর, একদম হাওরবাসীর কণ্ঠস্বর। গানের প্রতিটি লাইনে প্রতিবাদ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে বজ্রশব্দ আর শোষণমুক্ত সমাজের আহ্বান প্রতিধ্বনিত হতো। কৃষকের বিপন্ন জীবন, শোষিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি থাকতো এতে।
তাঁর গণসংগীতের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গান, ‘কাউয়ায় ধান খাইলো রে খেদানোর মানুষ নাই, খাইবার বেলায় আছে মানুষ কামের বেলায় নাই।’ সাম্যবাদী রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ তিনি গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে দিতেন। রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতি যে আন্দোলনের মেরুদ- এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি হাওরাঞ্চলে গণসংগীতকে জীবন্ত শক্তি বানিয়ে ছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে মেঘালয়ের একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেন এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শাল্লা ও আশপাশের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। শ্রীকান্ত দা’র কথাগুলো আজো আমার স্মৃতিতে নাড়া দেয়। তিনি বলেছিলেন- যে কাজটি মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি করেছিলেন, তা হলো প্রতি রাতেই তিনি গ্রামে-গ্রামে টহল দিতেন। পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি নজর রাখতেন এবং বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তথ্য সরবরাহ করতেন। এ কাজটি করতেন জীবন বাজি রেখে। এই মুক্তিযোদ্ধা এবং শিল্পী দুটি পরিচয়ই সমান তেজ বহন করেছিলেন শ্রীকান্ত দাশ। তাঁর গান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের মধ্যে ভয় কাটাতো, সাহস দিতো এবং স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলতো। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর ছিলো গভীর মানবিকতা। নিজের জীবনে কখনো বিলাসিতা চাননি। মানুষের কষ্টকে নিজের মনে ধারণ করতেন। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতেন। এমনকি মৃত্যুর পরও দেহদান করে গেছেন মানবতার সেবায়। প্রকৃতঅর্থে, তাঁর জীবন ছিল আত্মত্যাগের আলোয় ভরা।
আজ শ্রীকান্ত দাশ শুধু শাল্লার বা সুনামগঞ্জের নয়, বাংলাদেশের সংগ্রামী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক মূল্যবান অধ্যায়ের নাম। তিনি শিখিয়েছেন রাজনীতি মানে মানবিকতা, শিল্প মানে প্রতিরোধ, দেশপ্রেম মানে আত্মত্যাগ আর মুক্তিযুদ্ধ মানে স্বাধীনতার চেয়ে বড় স্বপ্ন মানুষের মুক্তি।
সবশেষে বলতে হয় কমরেড শ্রীকান্ত দাশের জীবন আমাদের শেখায় একজন মানুষ শিল্প, রাজনীতি ও দেশপ্রেমকে এক সঙ্গে ধারণ করতে পারে। তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন এক সংগ্রামের সুর, ন্যায়ের পথ প্রদর্শক ও শ্রমজীবী, কৃষক, দিনমজুর, জেলে, হাওরের সাধারণ জনগণের বন্ধু হিসেবে।
আজ ১৬তম প্রয়াণ দিবসে কমরেড শ্রীকান্ত দাশের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
শ্রদ্ধাঞ্জলি
কমরেড শ্রীকান্ত দাশ স্মরণে : বিজন সেন রায়
- আপলোড সময় : ১৯-১১-২০২৫ ০৪:২৫:১৩ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৯-১১-২০২৫ ০৪:৫৯:১৯ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ

সুনামকন্ঠ ডেস্ক